বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের বিদায়ের নেপথ্যে আমেরিকার হাত নেই বলে সম্প্রতি দাবি করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে সেই আমেরিকাই আবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক 'দৃশ্যপট শক্তিশালী' করতে ২৯ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে বলে জানায় ইলন মাস্কের ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি। এই নিয়ে ট্রাম্প আবার দাবি করেছিলেন, এমন এক সংস্থাকে ২৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছিল, যার নাম আগে কেউ শোনেনি। সেখানে মাত্র দুজন কর্মী কাজ করেন। তবে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকের তরফ থেকে ট্রাম্পের এই দাবিকে খারিজ করে কার্যত তাঁকে 'মিথ্যাবাদী' আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঙ্গে কি আমেরিকার সম্পর্ক আরও খারাপ হবে? সম্প্রতি এই প্রশ্নেরই মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশি বিদেশ উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। আর এই নিয়ে তাঁর দাবি, তাঁর মন্ত্রকের বিবৃতির কারণে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কে কোনও ধরনের প্রভাব পড়বে না। (আরও পড়ুন: USA-কে তাদেরই ভাষায় জবাব কানাডার, ট্রুডোকে 'অপমান' করে আরও আক্রমণাত্মক ট্রাম্প)
আরও পড়ুন: বাংলাদেশিদের 'হাহুতাশ', 'ভারত ভিসা না দিলে...', মুখ খুললেন বিদেশ উপদেষ্টা তৌহিদ
তৌহিদ বলেন, 'আমার মনে হয় না বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্কে কোনও প্রভাব পড়বে বিদেশ মন্ত্রের বিবৃতির জেরে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুধু একটি কথা বলেছিলেন। তিনি কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করেননি। আমরাও দেখেছি যে এ রকম কোনও কিছু নেই। এটি নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কিছু দেখি না। এটা (ট্রাম্পের দাবি) নিয়ে কোনও তদন্ত করা হয়নি। আমরা খোঁজ নিয়েছি যে বিষয়টি কী। এখানে দুই ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান আছে কি না। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, আসলে মার্কিন একটি প্রতিষ্ঠানকে টাকাটা দেওয়া হয়। তারা এখানে বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে কাজ করে। অর্থ সবই সঠিক চ্যানেলে এসেছে। এখানে দুই ব্যক্তিকে ২৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি সে রকম নয়।' এদিকে এর আগে 'উস্কানিমূলক' মন্তব্য করার জন্যে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করা হয়েছিল। এই আবহে ট্রাম্পের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হবে না? এই প্রশ্নের জবাবে তৌহিদের যুক্তি, 'বাংলাদেশ ট্রাম্পের মন্তব্যকে উস্কানিমূলক হিসেবে দেখছে না। তিনি এমন কথা বলেননি যে সেই টাকা বাংলাদেশি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। তাই এই নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ির কারণ দেখি না।' (আরও পড়ুন: সীমান্তপার ২টি রেল রুটে কাজ এগোবে, ভারতকে আশ্বাস প্রতিবেশী দেশের)
আরও পড়ুন: ভারত ছাড়া চলবে না, জানিয়েছিলেন 'মোদীর সঙ্গে কথা বলা' ইউনুস, ব্যাখ্যা তৌহিদের
এর আগে এই বিষয়ে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, 'ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য বিভ্রান্তিকর এবং তাতে জনমানসে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। সেই ভ্রান্তি দূর করার জন্যই বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে। এটা ঠিক যে বাংলাদেশে একটি প্রকল্প রূপায়নের জন্য ইউএসএইড-এর তরফে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু, সেই টাকা কোনও দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন সংস্থাকে দেওয়া হয়নি। ওই টাকায় 'স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিএল) ইন বাংলাদেশ' নামে একটি প্রকল্প রূপায়নের কথা বলা হয়েছিল। এবং সেই কাজের দায়িত্ব পেয়েছিল 'ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল' (ডিআই) নামে একটি সংস্থা। যাদের রেজিস্ট্রেশন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে। এবং তারা সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে, টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই কাজের বরাত পেয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, সেই সময়েই 'ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল' (ডিআই)-কে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। আর, ডিআই তাদের কাজ শুরু করেছিল ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ওই সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর।'
উল্লেখ্য, ইলন মাস্কের নেতৃত্বাধীন ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সির তরফ থেকে সম্প্রতি দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার খরচ করেছিল ২৯ মিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি DOGE-এর তরফ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করে এও জানানো হয়, বাংলাদেশের জন্যে বরাদ্দ এই অনুদান বন্ধ করা হবে। এই আবহে স্বভাবতই কৌতুহল জন্মায়, এই যে ২৯ মিলিয়ন ডলার ছিল, সেটা কার পকেটে গিয়েছিল? এই আবহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নিয়ে সম্প্রতি বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট শক্তিশালী করার নামে এমন এক সংস্থাকে ২৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছিল, যার নাম আগে কেউ শোনেনি। সেখানে মাত্র দুজন কর্মী কাজ করেন।'
এদিকে এর আগে বাংলাদেশে USAID-এর প্রকল্পগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ইউনুস সেই অনুদান চালুর আবেদন করলেও ট্রাম্প প্রশাসন এখনও তা কানে তোলেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের সঙ্গে ঢাকায় দেখা করেন মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি জ্যাকবসন। সেখানেই ফের মার্কিন সাহায্য চালুর জন্যে ট্রেসির কাছে আবেদন জানান মহম্মদ ইউনুস। তবে সেই অর্থ সাহায্য পুনরায় চালু করেনি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। উলটে ইউএস এইডের ২৯ মিলিয়ন ডলারের সেই অর্থায়নও বন্ধ করে দেয় তারা।
প্রসঙ্গত, বিগত বহু বছর ধরেই মহম্মদ ইউনুস 'ট্রাম্প বিরোধী' হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ে তিনি অস্বস্তিতে আছেন বলে মনে করছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা মদম্মদ ইউনুসের সঙ্গে মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের সুসম্পর্কের কথা অনেকেই জানেন। এর আগে ২০১৬ সালে ট্রাম্প জেতার পরে প্যারিসে এক অনুষ্ঠানে ইউনুস বলেছিলেন, 'ট্রাম্পের এই জয় সূর্য গ্রহণের মতো। কালো দিন আসছে। তা যেন আমাদের গ্রাস না করে, আত্মশক্তিকে দুর্বল না করে দেয়।' আর পরে যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিল, তখন নাকি ইউনুসের নাম না নিয়েই ট্রাম্প বলেছিলেন, 'ঢাকার মাইক্রোফাইন্যান্সের সেই ব্যক্তি কোথায়? শুনেছি, তিনি আমাকে হারাতে চাঁদা দিয়েছিলেন।' উল্লেখ্য, সেবার ট্রাম্প হারিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটনকে। আর ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে ইউনুসের ঘনিষ্ঠতা সর্বজনবিদিত। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে মার্কিন সফরে গিয়েও বিল ক্লিনটনের ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন ইউনুস। সেখানে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের 'মাথা' মাহফুজ আলমকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন ইউনুস। এই সবের মাঝে বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কি হয়, সেদিকে নজর আছে সবার। আবার সম্প্রতি মোদীর মার্কিন সফরকালে ট্রাম্প বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের বিষয়টা মোদী দেখে নেবেন।' যা নিয়ে জোর চর্চা হয়েছিল। তার মাঝেই ট্রাম্পকে কার্যত 'মিথ্যাবাদী প্রমাণ করে' বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক।